Saturday, July 15, 2017

দেবাশিস ভট্টাচার্য ‘শিবাজি’



আপন আমার রন্ধন
দেবাশিস ভট্টাচার্য ‘শিবাজি’

একটি জাতির কৃষ্টি, ট্র্যাডিশান গড়ে ওঠে যুগ যুগ ধরে, বহু প্রজন্মের একই ধরণের ব্যাবহারিক বৈশিষ্ট জোড়া লেগে লেগে সেই জাতির আইডেন্টিটি তৈরী হয় সেই সমাজের লোকেরা কি ভাষায় কথা বলে, কোন সামাজিকতার ছাঁচে নিজেদের ঢেলে নিয়েছে, কি খায়, কি পরে, এই সব কিছুই সেই জাতির নিজস্বতার অঙ্গ শিকড়ের টানে সেই দিকে চলতে গিয়ে দেখি আমার আমিত্বের একটা বড়ো জায়গা নিয়েছে আমাদের খাদ্যাভ্যাস আর সে তো শুধু পেট ভরানোর জন্যে নয় যখন কৃষ্টি বা ট্র্যাডিশানের দৃষ্টিতে দেখা যায় তখন তার একটা অন্য মাত্রাও চোখে পড়ে, যা আটপৌরে খাওয়াদাওয়ার অনেক উর্ধে সেটা নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় খাদ্য তৈরীর পদ্ধতিটা কেবল দিন গুজরানের জন্যে রান্না করা নয় রন্ধন একটা শিল্প

বাঙালীর ঘরে জন্ম নিয়েছি বলেই হয়তো রান্নার শৈল্পিক দিকটা অনায়াসে ধরা দিয়েছে আমার কাছে আমার অস্তিত্ব জুড়ে এই শিল্পকলার অবদান ও আবেদন নিরন্তর, অমলিন...... অনবদ্য অমৃত রান্না যে একটা শিল্প সেইটার প্রথম পরিচয় ঘটেছে আটপৌরে দৈনন্দিন জীবননির্বাহের মাধ্যমে জীবনধারণের জন্যে যে খাওয়া দাওয়া, তার মধ্যেও যে কতো রকমফের, কতো ভাবনাচিন্তা, কতো প্রকল্পায়ন, তা না বোঝার বয়স অতিক্রম করে বোঝার বয়েসে আসতে আসতে কখন যে আমাকে আকর্ষিত করেছে, তা ঠাহর হয় না

যা কিছু নান্দনিক তা সবসময়েই আমাকে টানে সাধারণতঃ শিল্পকর্ম বলতে যা বোঝায়, যা মনে আসে, সেসব তো আছেই ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া, টেরাকোটা, সূচীশিল্প অর্থাৎ সেলাই-ফোঁড়াই, গার্মেন্টস ডিজাইন আর টেইলারিং, উল-কাঁটায় সোয়েটারের নতুন নতুন ডিজাইন বোনা, বাটিক-বাঁধনি, কাটুম-কুটুম, আলপনা দেওয়া, ঘটে পটে আঁকা, গল্প বা কবিতার চিত্রবিন্যাস, কভার ডিজাইন, লোগো আঁকা, অরিগ্যামি, টেসেলেশান, ইকাবেনা-মরিবেনা, বাগান করা, ইন্টিরিয়ার ডিজাইন, বেতের আসবাবের ডিজাইন, কস্ট্যুম জুয়েলারি, কেশ বিন্যাস, কনে সাজানো, নাটকের বা নৃত্যশিল্পীর মেক-আপ করা, ফোটোগ্রাফি, তাদের নান্দনিক আবেদন দিয়ে সবাইকে আকর্ষণ করে, মন ভালো করে দেয়, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে উত্তেজিত করে, উদ্দীপ্ত করে এইসব শিল্পকলার সাথে রন্ধনশিল্পকেও আমি সমান আসনে দেখি এই সব শিল্পের প্রায় সবগুলোতেই আমি নিজে হাতে, নিজের অনুভব দিয়ে সৃজন করতে চেয়েছি, খানিকটা হয়তো সফলও হয়েছি হয়তো পুরষ্কার পাইনি কোনও, তবে আত্মীয় বন্ধুরা যখন তারিফ করেছে, ভালো বলেছে তখন আনন্দে যে মন ভরে গেছে, নতুন কিছু করার যে উৎসাহ পেয়েছি, তা স্বীকার না করে পারি? নন্দনকলার কোনও বিভাগেই আমার কোনও বিশেষ প্রশিক্ষণ নেই সবটাই চোখে দেখে, নিজের বোধে আর কেউ কিছু করছে দেখে দুএকটা কাজে কিছু সাহায্য অবশ্যই পেয়েছি অন্যদের কাছে দূর থেকে দেখে, কাছ থেকে দেখে, শেখার মন নিয়ে দুহাতে তুলে নেবার চেষ্টা করেছি নন্দনশিল্পের ভাণ্ডারের যা কিছু সুন্দর, মনোগ্রাহী, সৃজনশীলতার নিরিখে দুর্বার আবেদনময় উইন্ডো শপিঙে মনে মনে ঠাহর করে নিয়েছি গার্মেন্টসের কাটিং বাড়ী ফিরে খবরের কাগজ কেটে হাত পাকিয়ে তারপর কাপড় সেলাইকল নিয়ে বসে পড়েছি বানিয়ে নিয়েছি শিশুকন্যার জামা কাপড় এভাবেই চোখ কান খোলা রেখে এগিয়ে চলেছি মাথায় কোন কিছু গেড়ে বসলে তার শেষ না দেখে থামতে পারিনা, অবশ্যই নিজের হাতে করে সে যে কি আনন্দের

হ্যাঁ যে কথা দিয়ে শুরু করেছি তাতেই ফিরে আসতে চাই রন্ধনশিল্প রান্না করা ও পরিবেশন করাটা যে একটা আর্ট তা আগে বুঝতাম না তবে এই শিল্পে আকর্ষিত হবার মূলে আমার মায়ের হাতের অনবদ্য সব রান্নার পদ সেই সব পদের স্বাদ তো বটেই, গন্ধ আর দর্শনও আমার মনকে টেনে নিয়ে গেছে তার সৃজনের পশ্চাৎপটে আর সেই সময় থেকেই এই শিল্পকলার সাথে আমার আত্মিক পরিচয় ঘটতে থাকে

আমাদের ছোটবেলায় পরিবেশনটার অতো মাহাত্ম্য ছিলোনা আটপৌরে কাঁসার বাসনে, থালা-বাটি-গেলাসেই খাবার পরিবেশিত হতো খাগড়াই বাসনের সাথে কখনো সখনো ফুলকাটা, পাড়ে ঢেউতোলা বাটি বের হতো, জামবাটিতে বাবাকে পায়েস দেওয়া হতো আমার পছন্দের ছিলো একটা ভারী কানা-উঁচু থালা জলখাবারে চীনেবাসনের ব্যাবহার বা চলন ছিলো

চা নিয়ে চূড়ান্ত শৌখিনতা ছিলো আমাদের বাড়ীতে ফিনফিনে চায়ের পেয়ালা-পিরিচ হতে হবে, টীপটের ওপর মায়ের হাতের নকশী টীকোজীর জামা পরানো থাকবে কতক্ষণ, জলটা গরম কতটা হবে, দার্জিলিঙের মকাইবাড়ী, আসামের লামডিং, না কি অন্য কোনও বাগানের সুঘ্রাণী চাপাতা, ফ্লাওয়ারি অরেঞ্জ পিকো না কি ফার্স্ট ফ্লাশ, টীপটের ঢাকা খুলে কতবার চামচ নাড়িয়ে আবার ঢাকা ফিরিয়ে তারপরে চা ঢালা হবে সুগন্ধি চায়ে দুধের প্রবেশ নিষেধ সে ছিলো কড়া লিকারের আসামের চায়ের সঙ্গী, চিনির হাত ধরে এই সব খুঁটিনাটি দেখে শিখেছি বড়ো হতে হতে মণির শখের ফিনফিনে আদ্দির ধুতি পাঞ্জাবির সাথে ওঁর এই চায়ের সৌখিনতা বেশ মানানসই ছিলো দুধের চা বাবা আর সেজো কাকিমার পছন্দের ছিল, তাই বাবা বাড়ী ঢুকলেই কাকিমা চা করতে যেতেন, এক কাপ ওনার পছন্দের চাও হয়ে যেতো

আমার বাবাও দারুণ রান্না করতেন বাবা আর মায়ের genre  ছিলো আলাদা বাবার নিজস্বতা ছিল ভোগ রান্নায় আমাদের বাড়ীতে বারো মাসে তেরো পার্বণ, পুজো-আর্চা লেগেই থাকতো পৈতে হয়ে যাবার পরে আমাদের জোগাড়ে বামুনের ভূমিকায় নেওয়া হতো চালটা ধুয়ে দে, মুগডাল ভাজার সময়ে কড়াইতে একটু খুন্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করে দে, কাটা সবজিগুলোয় জল ঢেলে দে, এইসব তবে এইসব করার আগে কোঁচা দিয়ে ধুতি পরাটা চাইই চাই, নচেৎ প্রবেশাধিকার নেই বাবা আমিষ পদও রাঁধতেন হাত চেটে খাবার মতো করে তবে সেগুলো প্রধানতঃ আটপৌরে হিসেবের বাইরে হাঁস, কাছিম, মুরগি, পায়রা, তিতির বাবার হাতে খেয়েছি আর রাঁধতেন বাবা পায়েস, কদাচিৎ, কিন্তু সেই স্বাদ এখনো যেন জিভে লেগে আছে কোলকাতায় ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচ হলে বাবা সকালে আলুসিদ্ধ, ডিমসিদ্ধ, ডালসিদ্ধ, কাঁচালঙ্কা আর ঝাঁঝালো সর্ষের তেল দিয়ে মেখে নিজে খেতেন আর আমাদের সব ভাইদের গরাস গরাস খাইয়ে দিতেন সে ছিলো হাতের যাদু অমন মাখা আমি নিজে এখনো রপ্ত করতে পারিনি

এ হেন বাড়ীতে বড়ো হয়েছি বলে ভালোমন্দ খাওয়াটা কোনও বিশেষ ঘটনা ছিলোনা, বরং নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো আর খেতে খেতে, দেখে শিখে বাঙ্গালীর রন্ধনরত্নের সিন্দুকের ঢাকাটা খুলে গেছে আমার বোধের সামনে ধন্য হয়েছি আমি আমার পরিবারে জন্মিয়ে তাই মনে রেখে লিখে ফেললাম এক বৃহদায়তন কাব্য, রাঁধন পূরাণ লিখেছিলাম –

মা ঢাকা বিক্রমপুরের, শ্রীহট্টী পিতৃকুল-
রকমারি খাবারের প্রকার প্রতুল,
জন্ম ও বিবাহসূত্রে বাঁধা কলিকাতা
‘হিন্দোল’-এ লিখতে ছড়া খুললেম খাতা

সেই ছোটবেলা থেকে যা খেয়েছি তাই
পঞ্চাশোর্ধে ভাবি বসে লিখে রাখা চাই
হারিয়ে যায় যে সবই কালের নিয়মে,
চটকদারী পিৎজা-পাস্তা, কে-এফ-সি’র ভ্রমে
এমতাবস্থায় যদি না লিখিয়া রাখি –
ইতিহাস কেন? নিজেরেই দিব ফাঁকি

স্মৃতি-রান্নাঘরে পাকে খাদ্য যেমন,
সেইমতো হবে তার সুপরিবেশন
নিরামিষ আমিষ পদের ছড়াছড়ি –
মিঠে, ঝাল, টক, নোনা – আছে রকমারি
স্বাদেও যে বলে তারা একে অন্যে দ্যাখো,
করিতে পরখ তাহে নিজে রেঁধে চাখো
নামের মাহাত্ম্য তাহে ভিন্নতা দেয় –
‘কষা’, ‘দোপিয়াজা’, ‘ঝোলে’ প্রতিভাত হয়

বাংলার রান্নার এই বৃহৎকথা থেকে কিঞ্চিৎ তুলে দিলাম এই অবসরে

হ্যাঁ, পুরানোকে ঠেলে দিয়ে নতুন সবসময়েই তার নিজের জায়গা করে নেয় সেটা রোধ করা যায়ও না, আবার করাটা বোধয় ঠিকও না কিন্তু তা বলে প্রাচীন, সাবেকী বা আটপৌরে বাংলার রান্নার যে ঐশ্বর্য আমাদের আছে, আর যা শৈল্পিক নৈপুণ্যে আর পাঁচটা কারুকলার থেকে কোন অংশে কম যায়না, তা কেন হারিয়ে যাবে? হারিয়ে যেতে আমি দিতে চাইনা তাই, এই শিল্পেও আমি নিজে করে, খেয়ে, শিখে, লিপিবদ্ধ করে রাখতে চাই যাতে উত্তরসূরী প্রজন্ম জানে যে রান্না, বিশেষতঃ বাঙালীর রান্না একটা শিল্প

কাটাকাটি, বাটাবাটি দিয়ে শুরু করে এক একটা রান্নার পদের সৃজন গুণবত্তার পারদর্শিতার মাপকাঠিতে ওজন করে রংরূপ স্বাদ-গন্ধের সঠিক সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশনে এই শিল্পে পূর্ণতা পায় কিন্তু খাওয়ায় এর গুণের প্রধান বিচার হয় স্বাদ যদি সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়, রসনা তৃপ্ত হয়, তাহলেই এর সব থেকে বড়ো সার্থকতা কিন্তু লালশাক ভাজার ওপর যখন বড়ি বা চিনেবাদাম ভাজারা একটু নারকোল কোরার সাথে সেজে পরিবেশিত হয়, তখন কি মুখ দিয়ে ‘বাহ’ বেরিয়ে আসেনা? কলাপাতার মোড়ক খুলে ভাপা ইলিশের স্বর্ণালী আভা যখন ছড়িয়ে পড়ে, তখন সর্ষের ঝাঁঝে নাক খুলে যায়, চোখও বিস্মিত রংরূপের ছটায় সাদা সাদা ফুলকো লুচির পাশে কালোজিরে কাঁচালঙ্কার সাদা চচ্চড়ি আর পটলের দোলমা কাঁসার পদ্মকাটা থালায় সাজিয়ে দিলে কার বুকের পাটা আছে যে শিল্পকর্ম না বলে পারে? শ্বেতপাথরের গেলাসে বেলের পানা দিয়ে ওপরে সুন্দর একটা হাতে বোনা লেসের ঢাকনা দিলে ‘চমৎকার’ কথাটা তো আপনা আপনি বেরিয়ে আসবে, কি তাই না?

পৌষপার্বণে পিঠেপুলির রকমফের, অভিনবত্ব এবং চিরকালীনতা বাঙ্গালীর রন্ধনশিল্পের এক বিশেষ পরিচয়ের জায়গা আমাদের যৌথ পরিবারে সে ছিল এক সর্বৈব যৌথ প্রয়াস সবাই হাত লাগাতো সারারাতব্যাপী উৎসবায়োজনে সেটাও একটা সুযোগ ছিল হাতে কলমে রান্না শেখার সেই ছোট বয়সে 

এবারে আসছি আমি পার্বণী রান্নায়,
পৌষের পিঠে-পুলি ফিরে পেতে প্রাণ চায়
মনে পড়ে শৈশবে সংক্রান্তির দিনে
সারারাত কাটতো যে জেগে পিঠে রন্ধনে
পরিবারে যতোজন, জুটে যেতো সক্কলে,
ছোটরাও লেগে যেতো একটুকু ফাঁক পেলে
নারকোল কোরা কি বা পাটালির কুচি করা,
মাছ কি বা কচ্ছপ পুলির বদলে গড়া
দুধের পুলির সাথে চসিও বানানো হতো,
পিতলের হাঁড়ী ভরা পুলি পিঠে কতো শত
মুগ-পুলি গড়ে ভেজে, মিষ্টি আলুরও পুলি
গড়ে নিয়ে সযতনে নলেনের রসে ফেলি
রাতভর রাখা হতো নরমটি হবে বলে
ফুলে ফেঁপে উঠলেই তখন তা খাওয়া চলে
মা লেগে পড়তেন পাটিসাপ্টা গড়তেই
ক্ষীর ভরে, কোনটায় দিয়ে নারকোল ছেঁই
গোকুল পিঠেটি হতো চিনি সিরা ঘন করে,
ময়দা গোলায় খোয়াক্ষীরের পুরটি ভরে
মাটির ছাঁচ বাসনে হতো যে আস্কে পিঠে,
তার পাশে সরুচাকলি গরম তাওয়ায় ওঠে
এই দুই পিঠে খাওয়া নলেন পয়ড়া গুড়ে,
এ ছাড়া হাজারো পিঠে খাওয়া সারাদিন ধরে
  
এরপরেও মেনে নিতে কষ্ট যে রান্নাটা একটা শিল্প? নাঃ অনেকেরই হয়তো অসুবিধে হয় এটা নির্দ্বিধায় মেনে নিতে তা হোক, সেটা নিয়ে আমার কিছুই বলার নেই এটুকু বলতে পারি আমি সেই দলে নেই আমি যে এর শিল্পের স্বত্বাটাকে আন্দাজ করে নিয়েছি, চিনে নিতে পেরেছি তাই রন্ধন আমার বড়োই আপন আমার নিজের সার্বিক উন্মেষের একটা পথ রন্ধন আমার কাছে নতুন কিছু সৃষ্টি করার উৎসাহের জায়গা, আমার ক্লেশলাঘবের দিশারীও বটে  


DEBASISH BHATTACHARYA is a freelancer consulting Social Development Specialist, working in large-scale infrastructure development projects in India and abroad as well. An Anthropologist turned Regional Planner Debasish is fond of several activities from writing travelogues to cooking, from sketching, painting, photography to dress designing, embroidering to choreographing. Whenever he feels, in the early mornings or dead of nights, he sits with doing something creative that is so close to his heart.   


No comments:

Post a Comment