কুন্তলীন গল্পশতক
পাপিয়া রায়
বঙ্গাব্দ
১৩০৩ সাল| কুন্তলীন প্রতিযোগিতার শুরু| অভিনব এই
প্রতিযোগিতা - একাধারে বিজ্ঞাপন ও সাহিত্য সৃষ্টি| বাংলাদেশে এর
আগে এরকম কোনো প্রচেষ্টা হয় নি| ঘোষণা করা হলো যে এই প্রতিযোগিতায় যে কেউ যোগদান করতে পারেন
তবে গল্পতে যে কোনো একটি কুন্তলীন অথবা দিলখোশ পণ্যের উল্লেখ থাকতে হবে এবং গল্পের
সঙ্গে তার একটি গভীর সংযোগ থাকতে হবে| শ্রেষ্ঠ গল্প রচয়িতারা পাবেন পুরস্কার এবং তাদের গল্পগুলো
পুস্তক আকারে প্রকাশিত হবে|
বাংলা
সাহিত্যে এই প্রতিযোগিতার একটি বিশেষ স্থান আছে| বহু বিখ্যাত
লেখক প্রকাশ্যে বা ছদ্মনামে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন| বিশেষ
ভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম কল্প-বিজ্ঞান কাহিনী জগদীশ চন্দ্র বসুর
লেখা 'পলাতক তুফান'| অন্যান্য পুরস্কার প্রাপ্ত লেখকদের মধ্যে ছিলেন প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, ইন্দিরা দেবী, সৌরীন্দ্রমোহন
মুখোপাধ্যায়, এবং আরও অনেকে| আমাদের ছোটবেলার অনেক বিখ্যাত ছড়াও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল
এখানে, যেমন ‘ইকিরিমিকিরি চামচিকিরি’, ‘আগডুম বাগডুম’, ‘বৃষ্টি
পরে টাপুর টুপুর’, এবং ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’| ১৩৩৭ অবধি এই
প্রতিযোগিতা চলেছিল|
কুন্তলীনের
শ্রেষ্ঠ গল্পগুলি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছিল শ্রী বারিদবরণ ঘোষের সম্পাদনায়| তাঁর
এই প্রচেষ্টার জন্য আমরা তাঁর কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী| সংগ্রহটির
নাম "কুন্তলীন গল্প-শতক", প্রকাশক শ্রী সুরেশচন্দ্র দাস, মুদ্রক
শ্রী সন্তোষ কুমার ধর, প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২৫শে বৈশাখ, ১৩৬৯
সালে| বইটির ভূমিকা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য - সম্পাদকের নিষ্ঠা ও
গবেষণায় সমৃদ্ধ| বাংলা সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে ও ইতিহাসে কুন্তলীন পুরস্কারের যে অবদান তার প্রতি
দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের ভুলে যাওয়া অতীতের একটি অমূল্য ও স্মরণীয় অধ্যায় তিনি
আবার নতুন করে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন| আমি আশা করবো যে বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী যে কোনো পাঠক যেন অতি অবশ্য এই বইটি
পড়েন|
এই
সুবাদে কুন্তলীনের ইতিহাস সংক্ষেপে একটু বলে নেওয়া যাক এবং তার সঙ্গে কুন্তলীনের
জনক শ্রী হেমেন্দ্রমোহন বসুর কথাও|
শ্রী
হেমেন্দ্রমোহন বসু ময়মনসিংহ জেলার এক অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান, মেধাবী
ছাত্র ও জগদীশ চন্দ্রের নিকট আত্মীয় ছিলেন| প্রথম জীবনে গবেষণাগারে একটি দুর্ঘটনায় চোখে আঘাত পাওয়ায়
তাঁকে ডাক্তারি পড়ার আশা ত্যাগ করতে হয়| কিন্তু তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব| গতানুগতিক
জীবনের প্রার্থী তিনি ছিলেন না| যা কিছু নতুন তার প্রতি ছিল তার এক তীব্র আকর্ষণ| একাধারে
বিজ্ঞান, বিশেষ করে রসায়ন প্রীতি, আর স্বদেশ
প্রেম ছিল তাঁর প্রেরণা| তিনি ব্যবসায় নেমে পড়লেন| এইচ বোস
সাইকেল কোম্পানি নামে প্রথম দেশী সাইকেল কোম্পানি তিনি স্থাপন করেছিলেন হ্যারিসন
রোডে| তাঁর কাছে সাইকেল চড়া শিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র
রায় ও নীলরতন সরকার| 'দি গ্রেট ইস্টার্ন মোটর ওয়ার্কস' নামে
মোটরের শো রুম খুলেছিলেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে| বিদেশ থেকে
ফোনোগ্রাফ এনে শুরু করলেন 'দি টকিং মেশিন হল' - শুধু রেকর্ড বিক্রি নয়, তৈরি ও করতেন| রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, ডি এল রায়, প্রমোদারঞ্জন রাই, লালচাঁদ বড়ালের গান এবং মানদাসুন্দরীর গান প্রথম তিনিই
রেকর্ড করেন| ছবি তোলার শখও ছিল| রঙিন ফিল্মের ব্যবস্থা করেছিলেন প্রথম| পোর্টেবল
বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির একটি দোকান ছিল তাঁর| তার সঙ্গে খুলেছিলেন কুন্তলীন প্রেস|
কিন্তু
তাঁর সব থেকে প্রিয় বিষয় ছিল রসায়ন| তাঁর ল্যাবরেটরি-তে নানারকম গবেষণা করে তিনি সৃষ্টি করলেন
কুন্তলীন কেশ তেলের কারখানা ১২৮৭ বঙ্গাব্দে| কুন্তলীন কারখানায় তৈরি হতো নানা রকমের প্রসাধন দ্রব্য -
আতরিন, ল্যাভেন্ডার ওয়াটার, মৃগনাভি ল্যাভেন্ডার, ও ডি কোলন, মিল্ক অফ রোজ, টয়লেট পাউডার, টুথ পাউডার ইত্যাদি| আর ছিল দেলখোস সৌরভ| তার সঙ্গে ছিল নানারকম বিজ্ঞাপন| ১৩৫২
সালে প্রবাসী পত্রিকায় বেরোলো:
‘কেশে
মাখো 'কুন্তলীন'
রুমালেতে
'দেলখোস'
পানে
খাও 'তাম্বুলীন'
ধন্য
হোক এইচ বোস ||’
বিলাতি
পত্রিকাতেও বিজ্ঞাপন বেরোতো| বিখ্যাত ব্যক্তিরা এই সব পণ্যের প্রশংসাপত্র রচনা করতেন, এমনকি
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত|
তারপর
এইচ বোস এক অভিনব বিজ্ঞাপন প্রচারের দিকে মন দিলেন - একাধারে বিজ্ঞাপন, সাহিত্য-চর্চায়
উৎসাহ দান, আর স্বদেশিকতা| করলেন কুন্তলীন পুরস্কারের প্রবর্তন| লেখার
শর্ত ছিল 'গল্পের সৌন্দর্য কিছুমাত্র নষ্ট না কোরিয়া কৌশলে কুন্তলীন
এবং এসেন্স দেলখোশের অবতারণা করিতে হইবে, অথচ কোনো প্রকারে ইহাদের বিজ্ঞাপন বিবেচিত না হয়"| বিভূতিভূষণ
মুখোপাধ্যায় একবার মজা করে বলেছিলেন - 'তেলে-জলে কখনো মেশে না, কিন্তু তবুও
একথা মানতেই হয় যে অন্তত একটি তেলই আমাদের সাহিত্যরূপ জলের সঙ্গে নিত্যান্ত নিগূঢ়
ভাবেই মিশে আছে| সেটি কুন্তলীন|"
১৩২৩
সালে হেমেন্দ্রমোহন বসুর অকালমৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিতেন্দ্রমোহন এই
প্রতিযোগিতার ভার গ্রহণ করেন|
এরপর
আসি কুন্তলীন গল্পের আলোচনায়| প্রথম বর্ষের প্রথম পুরস্কার পান জগদীশচন্দ্র বোস - তাঁর গল্পের নাম ছিল 'নিরুদ্দেশের
কাহিনী', পরে তা ‘পলাতক তুফান’ নামে মুদ্রিত হয়| বৈজ্ঞানিক মানুষ তাই বিষয়টিও বিজ্ঞান| লেখক
ভয়ানক জ্বরের পর ডাক্তারের পরামর্শ মতো সমুদ্র যাত্রায় বেরোলেন| জ্বরে
বিরল কেশ আরো বিরল হয়ে পড়েছিল| তাঁর অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা এক শিশি কুন্তলীন তেল সঙ্গে দিয়ে
দিলো| যাত্রার দুদিন পরে প্রচন্ড ঝড় উঠলো| মনে
হলো হয়তো বা অন্তিম কাল উপস্থিত| তখন মরিয়া হয়ে তিনি কুন্তলীনের শিশি খুলে সেই তেল নিক্ষেপ
করলেন| ইন্দ্রজালের মতো সমুদ্র শান্ত হয়ে গেলো|
Scientific American-এ লেখা বেরোলো – “It would appear that a passenger on board the
Chusan threw overboard a bottle of KUNTALINE while the vessel was in the Bay of
Bengal, and the storm was at its height. The film of Oil, spread rapidly over
the troubled waters, and produced a wave of condensation, thus counteracting
the wave of rarefaction to which the cyclone was due…”
প্রায়
সাতশো পৃষ্ঠার এই বৃহৎ সংগ্রহে একশোটি গল্প স্থান পেয়েছে| প্রত্যেকটি
গল্পই স্মরণীয় কিন্তু তার মধ্যেও কয়েকটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য| দ্বিতীয়
বছরে প্রথম পুরস্কার পেলেন শ্রীমতি রাধামনি দেবী; গল্পের নাম ‘পূজার
চিঠি’| ইনি আর কেউ নন ছদ্মনামে শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়| স্ত্রী
পত্র লিখছেন স্বামীকে - তাঁর সঙ্গে সবার জন্য পুজোর উপহারের ফরমায়েশ|
১৩০৯
সালে প্রথম পুরস্কার প্রাপ্ত গল্প 'মন্দির', লেখক সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়| ছদ্মনাম
এটিও, শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের| মাতুলের নামে
এটা তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প| গল্পের নায়িকা অপর্ণা তার মন প্রাণ উজাড় করে দিয়েছে
গৃহদেবতা মদনমোহনের পায়ে| বিবাহের পর স্বামী অমরনাথ স্ত্রীর কাছে শুধু উপেক্ষা পেয়ে
শেষ অবধি ভগ্ন হৃদয়ে মারা গেলেন| অপর্ণা পিতৃগৃহে ফিরে এসে দেবসেবার ভার নিলো| এবার
তার পায়ে সরল শক্তিনাথ এবং তারও একই দশা হলো| অপর্ণার ভুল ভাঙলো কিন্তু অনেক দেরিতে|
মানকুমারী
বসুর 'রাজলক্ষ্মী' গল্পতে আমরা দেখি গরিব দুঃখিনী প্রফুল্লকে| জমিদার
পুত্র পূর্ণচন্দ্র তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে বিবাহ করতে চেয়েছিলো কিন্তু পরে অসুখে
তার মুন্ডিত মস্তক ও কৃশ চেহারা দেখে মত পাল্টে ফেলে| ডাক্তারের
পরামর্শে মাথায় কুন্তলীন তেল মেখে সে আবার তার রূপ ফিরে পায় এবং রাজার ঘরে তার
বিবাহ হয়|
দীনেন্দ্রকুমার
রায়ের 'বিধবা' গল্পে দুর্ভাগিনী বিধবা চারু সবার অত্যাচার গঞ্জনা সহ্য
করেও তাহার স্বামীর দেওয়া কুন্তলীন ও দেলখোস বুকে আঁকড়ে পরে রইলো, তার
ননদকে দিতে রাজি হলো না| 'অদল বদল' গল্পে কুন্তলীনকে ঘিরে তিনি রীতিমতো এক রহস্য কাহিনী
লিখেছিলেন যাতে নকল তেল দিয়ে মানুষ খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করার ভার পড়লো এক সরকারি
পুলিশ গোয়েন্দার ওপর|
এই
সংকলনটিতে ইন্দিরা দেবীর পাঁচটি গল্প স্থান পেয়েছে – ‘ভুল’, ‘ছুটি’, ‘পুরস্কার’, ‘ঋণ
পরিশোধ’, ও ‘বহ্বারম্ভ’|’ভুল’ এবং ‘বহ্বারম্ভ’ গল্প দুটি প্রেমের গল্প - একটি বিয়োগান্তক ও একটি মিলনান্তক| ‘ছুটি’ গল্পটি
রাইচরণ বলে একটি ভৃত্যের প্রভু-ভক্তির করুণ কাহিনী| ‘পুরস্কার’ ভগিনীর
প্রতি ভ্রাতার স্নেহের গল্প আর ‘ঋণ পরিশোধ’ বন্ধুত্বের গল্প|
এ
ছাড়াও এই সংগ্রহটিতে আছে চেনা-অচেনা অখ্যাত-বিখ্যাত বহু লেখক-লেখিকার রচনা| এদের
মধ্যে আছেন সরলাবালা দাসী, সুরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, সূর্যদ্রনাথ গঙ্গপাধ্যায়, স্নেহলতা সেন, বিন্দুবাসিনী
দেবী, প্রতিভা দেবী, বিনয়ভূষণ সরকার, যোগেশচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন
মুখোপাধ্যায়, প্রমীলা দত্ত, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, পূর্ণশশী
দেবী, ললিতমোহন মজুমদার ইত্যাদি| প্রতিটি
গল্পে কুন্তলীন ও দেলখোস অঙ্গাঙ্গিভাবে কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে|
কবিতা
ও ছড়াগুলিও উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে অম্বুজাসুন্দরী দাসীর লেখা ‘বুদ্ধিমান
রাজার স্বর্গযাত্রা’ এবং
হরকুমারী সেনের ‘জামাই বেটার উপাখ্যান’| এখানেও কুন্তলীনের প্রশংসা লক্ষণীয়:
‘"কুন্তলীন"
কুন্তলের সর্বোৎকৃষ্ট তৈল
মৃদুল
বাতাস ভোরে
সুগন্ধ
বিস্তার করে
মস্তক
শীতল রাখে করিলে মর্দন
রমণীর
কেশ শোভা করে সম্পাদন |’
[কামিনীকুন্তল
- শশীভূষণ মজুমদার]
বৃহৎ
এই সংগ্রহের যথার্থ আলোচনা এইটুকু লেখায় সম্ভব নয়| বারিদবরণ
ঘোষের এই প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে| বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের এই বিশেষ অধ্যায়ের বিশদ বিবরণ
অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল| বইটির প্রথম মুদ্রণের প্রায় পঞ্চান্ন বৎসর পরে আজও এটি
প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ| এবং আমার মনে হয় আজকের পাঠক-পাঠিকাদের কাছেও এর সমাদর কিছু
কম হবে না|
No comments:
Post a Comment