আলোকের
এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও
শ্রীশুভ্র
আলো আমার,
আলো ওগো, আলোয় ভূবন-ভরা, আলোয় নয়ন- ধোয়া আমার, আলোয় হৃদয়- হরা। নাচে আলো,
নাচে ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে—বাজে আলো বাজে, ও ভাই, হৃদয়বীণার
মাঝে” এত আলো! চারিদিকে! যে আলোর স্রোতে পাল তুলেছে
বিশ্বভূবন! যে আলোর সাজে সাজতে ভালোবাসে মানুষের অন্তর্দীপ্ত বিবেক, সভ্যতার সেই ঊষা লগ্ন থেকেই! সেই আলোতেই কি আমরা আমাদের চেতনার সব
ঘরদূয়ারগুলো ধুয়ে নিতে চাইনা? মন মননের মাস্তুলে সেই আলোর
পাল তুলে ভালোবাসার উজানে কে না চায় পাড়ি দিতে? কিন্তু
বাস্তবে কি সত্যিই তাই ঘটে? আমাদের চারপাশের এই চেনা অচেনার
জগতসংসারের আটপৌরে জীবনের দৈনন্দিন চৌহদ্দিতে? অন্তত গড়পড়তা
হিসেবের চেনা জানা পরিসংখ্যান কি সেই কথাই প্রমাণ করে? নাকি
মানুষের ইতিহাস একটু অন্য চিত্রই তুলে ধরে? অনেকেই বলেন আলো
অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, শুভ অশুভের দ্বৈরথ আর তার মধ্যেই পথ করে
এগিয়ে চলা, চরৈবেতি চরৈবেতি- এটাই জগতসংসারের মূল স্বরূপ।
খুবই সত্যি কথা! কিন্তু এগিয়েই চলা তো? নাকি এগনোর তালে তালে
তলে তলে আবার সেই শুরুর বলয়েই ফিরে আসা? কোনাো একটি
স্থানাঙ্ক কে কেন্দ্র করে যে ঘূর্ণন, তার প্রতিটি মুহূর্ত্তই
কিন্তু পূর্ববর্তী ক্ষণ ও স্থানাঙ্ক থেকে ক্রমাগত এগিয়ে চলাই। কিন্তু সমগ্র পথের
হিসেব নিলে স্পষ্ট হয়, সে এগনো আসলে কিন্তু আবার সেই শুরুর
মুহূর্ত্তেই ফিরে আসা। সভ্যতার চরৈবেতি
ঠিক সেই রকম এগনো নয়ত?
যে আলোর কথা বলছেন বিশ্বকবি, সেই আলো যদি
সত্যিই আমাদের আপামরের হৃদয়বীণায় বাজত তবে কবির কথাতেই প্রশ্ন করা যায়, আজও ‘বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে’ কাঁদে কেন? কাঁদে যে সে’তো রোজ
সকালের প্রভাতী আলোয় প্রভাতী সংবাদে চোখ রাখলেই কান পেতে শোনা যায়। তাহলে কোথাও কি
কোনো গন্ডগোল রয়ে যাচ্ছে? তাইতো মনে হয়। একটু ভাবলে বুঝতে
পারি, গন্ডগোলটা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে! আমাদের
লোভ লালসা ঈর্ষা দ্বেষ ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির উদগ্র তড়না আর রক্তের কোষে কোষে
হিংসার অনির্বাণ প্রবৃত্তি- আমাদেরই চারদিকে অন্ধকারের যে বলযটি তৈরী করে রাখে;
সেই বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না চৈতন্যের আলো! মানব সভ্যতার
এইটিই নিদারুণ অভিশাপ! এবং মানুষের ইতিহাস মূলত এই অন্ধকার বলয় থেকেই উত্তরণের
প্রাণান্তকর প্রয়াসের ইতিহাস। এই অভিশাপ মুক্তির দূর্বার স্বপ্নের ইতিহাস। কিন্তু
তবু কি সফল হয় সেই প্রয়াস? সার্থক হয় হয় আলোর স্বপ্ন?
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন জনপদ, বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন যূগে সেই
সাফল্যকেই পাখির চোখ করে এগনোর প্রয়াস করে চলেছে। কিন্তু চললেও আজও কত অন্ধকার
ক্রমাগত ঘিরে ধরে আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে। আর তখনই প্রশ্ন জাগে তাহলে কি আমরা
আসলেই এগনোর পথ ধরে চলতে চলতে আসলে সেই একই অন্ধকারকে প্রদক্ষিণ করে চলছিনা?
চলছিই তো। চলছে বলেই
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেও হাজার হাজার যুদ্ধ সংঘঠিত করেও আজও ধর্ম
সংস্থাপন অধরাই রয়ে গেল। হাল আমলের দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ- যা নাকি অশুভ শক্তির
পরাজয়ে শুভ শক্তির জয় বলে ইতিহাস বন্দিত,
সেও ধর্ম সংস্থাপনে ব্যার্থ পুরোপুরি। মানুষের যূদ্ধ আজ অব্দি
ক্ষমতার হাতবদলের যুদ্ধ, ধর্ম স্থাপনের যুদ্ধ নয়!
মারণাস্ত্রের ব্যবহারে ধর্ম স্থাপন অসম্ভব। বস্তুত মারণাস্ত্রই অধর্মের প্রমাণ।
তাই দিয়ে কি করে সম্ভব ধর্ম প্রতিষ্ঠা? তাই কুরুক্ষেত্রও
ব্যর্থ- অন্ধকারের বলয়ে চৈতন্যের আলো প্রজ্জ্বলনে। ব্যর্থ কারণ আমাদের চরৈবতি মূলত
একটি ঘূর্ণন প্রক্রিয়া মাত্র। তা আমাদের কোনো ভিন্নতর স্তরে বা নতূনতর ভূবনে
পৌঁছিয়ে দিতে পারে না। কেননা আমরা আজও লোভ লালসা ঈর্ষা দ্বেষ জনিত ক্ষুদ্র
স্বার্থবুদ্ধির উদগ্র সেই তারণা আর আমাদের রক্তের অন্তর্গত হিংসার অনির্বাণ
প্রবৃত্তির কবল থেকে আমাদের নিজেদেরকেই মুক্ত করতে পারিনি। পারিনি বলেই আমাদের
চারপাশের এত নিত্যনতুন অন্ধকারের নীরেট বলয় আমাদের চৈতন্যের শুভ আলোকে বিকশিত হতে
দেয় না!
আর তখনই মাথা তুলে দাঁড়ায় অন্ধকারের বিষাক্ত ফণা! তার
বিষাক্ত ছোবলে যত্রতত্র নিরবে নিভৃতে কাঁদতে থাকে বিচারের বাণী তার নির্বাক অভিমান
নিয়ে। বৈষম্য শোষণ অত্যাচার নিপীরণ নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে দূর্বলের জীবন। আর বিভেদের
মন্ত্র আউড়িয়ে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে মিথ্যার জাল বিছিয়ে অপপ্রচারের দুন্দুভি বাজিয়ে
অন্ধকারের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে যাবতীয় অশুভ শক্তি, অশুভ আঁতাতের হাত
ধরে। এটাই তো এই পৃথিবীর শাশ্বত ইতিহাস! মানুষের অতীত। মানুষের বর্তমান। আর
ভবিষ্যতের মলিন দিশা। অন্ধকারের এই যে ভয়াবহ আরতি, তা আমাদের
ঘরসংসার সমাজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস সর্বত্রই প্রতিদিনের
সত্যি! যে সত্যি’র ভয়াবহ চিত্র শিহরিত করে তুলবে যে কোনো
শুভবোধ জাগ্রত মানুষের বিবেককে। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর অবস্থান, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির তৃতীয় বিশ্বে দরিদ্র্যের অবস্থান, একমেরু বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বের অবস্থান; সেই সব
সত্যিরই এক একটি ভয়াবহ চিত্র! যা আমাদের কেবলই ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর করে তোলে।
আর ঠিক সেই প্রেক্ষিতেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে আমরা, ‘চাচা
আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের গন্ডীতেই
গুছিয়ে নিতে চাই নিজেদের আশু ভবিষ্যৎ! অন্ধকারের মূল বীজটি ঠিক এইখানেই বপন করতে
থাকি আমরা, হয়ত নিজের অজান্তেই! আর তাই আমাদের যে এগিয়ে চলার
কথা ক্রমাগত সামনের দিকে- স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর আলের অভিমুখে; সেই চলা কার্যত কেবলই ঘুরতে থাকে ঐ অন্ধকারের বীজটুকুকেই কেন্দ্র করে
আবর্তিত হয়ে। তাই আলো অন্ধকারের দ্বন্দ্ব, শুভ অশুভের
দ্বৈরথের মধ্যে দিয়ে যে চরৈবেতি- এগিয়ে চলা; বস্তুত তা
আমাদের কোনো আলোর জগতে পৌঁছিয়ে দিতে পারে না আদৌ।
তাইতো বিশ্বকবি মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে
দেওয়ার জন্যে প্রার্থনা করে বলেন,
‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলোর ঢাকা
ধুইয়ে দাও’। এই
ধুলোর ঢাকাই সেই অন্ধকার যা আমাদের এগিয়ে চলাকে কেবলই অন্ধকারেরই চারপাশে আবর্তিত
করতে থাকে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় একটিই। যার সূত্র দিয়ে গিয়েছিলেন সর্বপ্রথম
স্বয়ং বুদ্ধদেব; মৃত্যর পূর্বে প্রিয় শিষ্যদের বলে গিয়ে ছিলেন- “আত্মদীপভব”
আর তাইতো বিশ্বকবি গাইলেন, ‘যে যন আমার মাঝে
জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে, আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপাল এই
অরুণ আলোর সোনার কাঠি ছুইয়ে দাও’। কবির কথায়, আমাদের পরাণ-বীণায়
যে অমৃতগান ঘুমিয়ে আছে, যার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান; তাকেই
আলোকের এই ঝর্ণাধারার আনন্দে জাগিয়ে তুলতে হবে। হয়তো তবেই আর গোলক ধাঁধার আবর্তে
নয়, আমাদের এগিয়ে চলা সত্যই সম্মুখ পানে অগ্রসর হওয়া হবে।
কিন্তু কি ভাবে সম্ভব এইভাবে জাগিয়ে তোলা? কি ভাবে সম্ভব
বুদ্ধদেব কথিত ‘আত্মদীপভব’ হয়ে ওঠা! পথ
কিন্তু একটিই! আর সেটি হল মানুষ গড়ে তোলার প্রকৃত যে শিক্ষা, সেই শিক্ষা বিস্তারকে করে তুলতে হবে সর্বব্যাপী। যে কাজে আজও হাত দেওয়াই
হয়নি! সেই কাজটির সার্থকতার সাথে সাথেই মানুষের অন্তরে প্রজ্জ্বলিত আলোর অভিসারে
সমাজ সংসারে বদলাতে থাকবে নারীর অবস্থান। ছিন্ন হতে থাকবে দারিদ্র্যের অভিশাপ। আর
তখনই একমাত্র সম্ভব প্রকৃত আলোর অভিমুখে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সর্বজনীন অগ্রসরণ! যে
অভিমুখ হিংসা দ্বেষ লোভ লালসা ঈর্ষা ও ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির বিপরীত অবস্থানে মুক্তি
দেবে আমাদেরকে, সমস্ত অন্ধকার থেকে। আর তখন ক্ষমতার
দ্বন্দ্বকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধ বলে মিথ্যা প্রচারের দুন্দুভি বাজানো
সম্ভব হবে না। ধর্ম সংস্থাপনের জন্য প্রয়োজন হবে না কোনো কুরুক্ষেত্রের। আর
সেইদিনই বেজে উঠবে ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি’। আমরা সবাই মিলে নিঃসংশয়ে
বলতে পারব, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে.....’
সেই আলোর পথরেখা ধরে পরিপার্শ্বের অন্ধকার বলয় থেকে
মুক্তির অভীপ্সায় এগোতেই ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দেওয়ার’ শপথ নিয়েই পথচলা শুরু হয়োছিল মাসিক
সংশপ্তকের।
২০১৪ সালের পঁচিশে বৈশাখের শুভ মুহূর্তে। বিগত তিন বছরের সংশপ্তকের সংক্ষিপ্ত
ইতিহাসে রয়ে গিয়েছে সেই পথ পরিক্রমণের উজ্জ্বল কিছু মুহূর্ত। ভালোয় মন্দে আমাদের সেই ঐকান্তিক প্রয়াসে বিশ্বের নানান
প্রান্তের মানুষের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, সৃষ্টি ও মনীষা এসে মিলেছিল মাসিক
সংশপ্তকের পাতার পর পাতায়। পাঠকের সাথে আমরাও ঋদ্ধ হয়ে উঠছিলাম আবিশ্ব চেতনার
পরিভ্রমণে। কিন্তু সবকিছুই সবসময়ে একরৈখিক চলে না। নানান প্রতিবন্ধকতা এসে পথরোধ
করে দাঁড়ায়। উদ্ভূত সমস্যা পথশ্রমের ক্লান্তি বাড়িয়ে তোলে। সেই রকমই একটি সময় পার
করছিলাম আমরা সাম্প্রতিক সময়ে। কিন্তু তাই বলে থেমে যাওয়াটাও কোন কাজের কথা নয়।
নতুন উদ্যোমেরও প্রয়োজন পড়ে সময়ে অসময়ে। আর সেই কারণেই একটানা তিন তিনটি বছর মাসিক
পত্রিকা হিসাবে পরপর ছত্রিশটি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর, সংশপ্তক সম্পাদকমণ্ডলীর
পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এই চতুর্থ বৎসর থেকে সংশপ্তক প্রকাশিত হবে ত্রৈমাসিক
ভাবে। সেই মতোই ত্রৈমাসিক সংশপ্তকের প্রথম সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হল ত্রৈমাসিক
সংশপ্তক জুলাই ২০১৭ সংখ্যা। এখন থেকে প্রতি বছর জানুয়ারী এপ্রিল জুলাই ও অক্টোবর
মাসেই প্রকাশিত হবে ত্রৈমাসিক সংশপ্তক। আমাদের আশা বিগত বৎসরগুলির মতোই নতুন রূপে
নতুন সাজে ত্রৈমাসিক সংশপ্তক আমাদের পাঠকবর্গের আশা পূরণ করতে সফল হবে।
No comments:
Post a Comment