Saturday, July 15, 2017

সন্তু দত্ত



চেনা শহর, অচেনা আকাশ
সন্তু দত্ত


অনেকদিন পর কলকাতায় গিয়ে চেনা শহরটাকে কেমন যেন অচেনা লাগছিলো অনেক কিছু পাল্টে গেছে এক শতাব্দীর স্টান্টেড গ্রোথ কাটিয়ে কে জানে কোন টনিকের জোরে কলকাতা হঠাৎ লম্বা হতে শুরু করেছে বিশ্বায়নের টনিক বোধ হয় আমাদের পুরোনো পাড়াতেই সারি দিয়ে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট বাড়ি তাদের নামগুলোও  একটু অচেনা...কোনটা আয়ুষ, কোনটা সিদ্ধার্ত। কে যে ফ্ল্যাট নামখানা দিয়েছিলো কে জানেএকেবারে যাকে  ব্যাকরণে বলে বিপরীত অলঙ্কার কোনো জমি আর ফ্ল্যাট নেই লাল নীল ক্যাটকেটে সবুজ রঙের ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দা থেকে ফর ফর করে প্রাউড ওনারদের শাড়ী সালোয়ার পায়জামা এমনকি অন্তর্বাস পর্যন্ত ঝুলছে রাস্তার ওপরও এসে পড়ে কখনো কখনো। আর পড়ছে পলিপ্যাকে ভর্তি পুঁটলি করে জঞ্জাল মার ঝাড়ু মার ঝাড়ু  মেরে ইতনা জঞ্জাল হয়, সেগুলো ফেলার জায়গা কলকাতা শহরে নেইতাই ফ্ল্যাটের মর্জিনাদের মর্জিমতো, ঠিক রাস্তার ওপর ড্রেনের ধারে। থপ করে, ঠিক দুপুর বেলা যখন ভূতে মারে ঢেলা তখন মর্জিনা দেবী চারতলার বারান্দা থেকে এদিক ওদিক তাকিয়ে টুপ্ করে পলিপ্যাক ফেলে দেন এটা পরিচিত দৃশ্য ছি ছি ইতনা জঞ্জাল প্রত্যাশিতও বটে সুতরাং চেনার অসুবিধে নেই তাও কেন যেন সব কিছুতেই একটু অচেনা অচেনা গন্ধ ছাদে গিয়ে বুঝতে পারলাম কারণটা কলকাতার আকাশ ভালো করে দেখতে দেখতে এখন ছাদে যেতে হয় বনফুলের গল্পেই বোধ হয় কলকাতার আকাশ দেখতে এগিয়ে গ্রামের কোন এক কিশোর গাড়ি চাপা পড়ে মরেছিল, সেই আকাশ এখন সব সময় মেঘলা একটু ভুল বললাম বোধ হয় এ সেই বিশ্বজিতের মেঘলা দিনের রোমান্টিক  মেঘলা নয় বরং বলা যেতে পারে ঘোলাটে ছাই ছাই ঘোলাটে রঙের আকাশ টুয়েন্টি ফোর সেভেন, যতদিন ছিলাম প্রত্যেকদিন সেই ঘোলাটে রং কলকাতার পলুশন ইনডেক্স কত কে জানে, এটাও বোধ হয় বিশ্বায়নের প্রভাব ছোটবেলায় যখন নীলে নীলে অম্বর দেখা যেত তখন এরকমই ভর দুপুরে একটা লোক ভ্যান রিক্সা ঠেলতে ঠেলতে চিৎকার করে যেতভাঙা পুরানা লোহা টিনা শিশি বোতল বিক্রীওয়ালা....ওর মাথায় সবসময় একটা গামছা জড়ানো থাকতো হিন্দি বলতো ওর নাম ছিল রামস্মরণ কতবার করে ওর সেই গামছা টেনে খুলে নিয়েছি কে জানে অনেক অনুরোধ উপরোধ করেও সেই গামছা উদ্ধার করতে না পেরে সেই মুকুটহীন রাম অগত্যা রোয়াকে বসে পড়তো দে দো বাবুয়া...মেরা দের হো যায়েগা...মেটিয়াবুরুজ জানা হায় কে জানে মেটিয়াবুরুজে এতো ভাঙা টিনা লোহা দিয়ে কি হয় এখন ওই আগের মতোই একটা লোক আসে সেই রামস্মরণের মতোই হাঁক দিতে দিতে যায় সেই ঝড়ঝড়ে ভ্যান রিক্সাটা  নেই লোকটার পিঠে ঝোলা সেই ডাকটা অবশ্য অনেকটা একই রকমএকটু পাল্টেছে, লোহা টিনা আর নেই পুরানা ল্যাপটপ পুরানা মোবাইল বিক্রীওয়ালা আছে কে জানে রামের ছেলে কিংবা নাতি কিনা জিজ্ঞেস করলাম এই তুমি রামস্মরণকে চেনো পরিষ্কার বাংলায় উত্তর পেলাম আজ্ঞে স্যার না চিনি না আরে এতো বিহারী নয় মায়াবন বিহারী বাঙালী রাস্তায় নেমে পড়ছে লোহা কেনা বেচা নয় রীতিমতো সিলিকন ভ্যালি কিনে নিচ্ছে সস্তায় অমিত রায়ের ই মেল  থাকলে বলতে পারতাম শুনতে পাচ্ছি স্যার, পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি, সেই আপনার কালের যাত্রার ধ্বনি, শুধু রথটা থুড়ি ভ্যান রিক্সাটা মিসিং

ভ্যান রিক্সার বদলে একটা নতুন উপদ্রব বেড়েছে মোটরবাইক সেই রথ নিত্যই কানের পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে ভীষণ শব্দ করে তার ধ্বনি না শুনে উপায় নেই তার পেছনের সিটে  লাবণ্য থেকে বন্য সবাই আছে কালের যাত্রাপথে সেই দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে বন্য না হয়ে গতি কি দুঃসাহসী না হলে বি টি রোডের ট্রাফিক নেগোশিয়েট করে বাইক চালানো যায় না একদিন রাতের বেলা একটা  ফ্ল্যাট বাড়ির তলায় দেখলাম একদল অল্পবয়েসী মেয়ে আগুন জ্বালিয়ে হল্লা করছে এটা নতুন দৃশ্য কাছে আসতেই হাতে একমুঠো গরম পপকর্ন ধরিয়ে দিলো পরসাদ...প্রসাদ? এই পৌষ মাসে আবার কি পুজো? লোরি হায় জি প্রথমে ভেবেছিলাম লরী লরী দেবতা হাসবেন না প্লিস, না হওয়ার কোনো কারণ নেই এতো ট্রাক লরী বি টি রোডে তাদের একটা দেবতা হলে অসুবিধে কোথায়? তারপর বুঝলাম লরী নয় লোরি ভক্তি ভরে প্রসাদ খেলাম বেশ খেতে এই লোরি দেবতা বেশ মডার্ন দেখছি পাড়ার মিষ্টির দোকান আনন্দময়ী মিষ্টান্ন ভান্ডার তারও বিবর্তন হয়েছে নলেন গুড়ের সন্দেশের  পাশে গাজর কি হালওয়া শোভা পাচ্ছে বাউল হলে গাইতাম... মানাইছেনাই গো...এক্কেবারে মানাইছেনাই গো।

আরো একটা পরিবর্তন হয়েছে এটা ভালো না খারাপ বুঝে উঠতে পারছি না মশা মাছি পোকা মাকড় সব উধাও পোকা মাকড় এমনই কম যে সেই ওম্নিপ্রেসেন্ট হাউসহোল্ড সিলিঙের টিকটিকির টিকিটি খুঁজে পেলাম না জিজ্ঞেস করতে উত্তর পেলাম, ওরা নাকি এখন মেঝেতে ঘুরে বেড়ায়,বিস্কুট আর পাউরুটির টুকরোর খোঁজে কত সন্ধ্যে মিথ্যে মিথ্যে বই হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে এদের হান্টিং স্কিল পর্যবেক্ষণ করে চমৎকৃত  হয়েছি তখন তো আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল ছিলনা আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোর জন্য খুব দুঃখ হলো সত্যি আরো একটা ডাইনোসর এইজ শেষ হলো বোধ হয় 

এই এতো অচেনার মধ্যে একটাই সান্তনা আমাকে সবাই চিনতে পারছে দেখে বড় রাস্তা ক্রস করতে করতে পরিচিত গলা পেলাম একজন বৃদ্ধ মানুষ কবে এলে? চিনতে পারলাম, আমাদের ফিজিক্সের টিচার সেলুনে চুল দাড়ি কাটতে কাটতে এক ছোকরা বেরিয়ে এলো চিনতে পারছো সন্তু দা? না পারলাম না পারবো কি করে, অনেকদিন দেখিনি তোমার বোধ হয় তখন গোঁফ দাড়ি বের হয়নি নতুন মিষ্টির দোকানটায় মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে মিষ্টির দোকানি মিষ্টি মিষ্টি হেসে বললো চিনতে পারোনি নিশ্চই ফ্যাল ফ্যাল করে দোকানদারের দিকে তাকালাম কে বাবা তুমি? আরে আমি দোকানদার নই আমি গৌতম এবার মনে পড়লো বিশ্বাস বাবুর ছোট ছেলে সন্ধ্যে হলেই সুর করে বই পড়ত কেন জানিনা ফেল করত প্রতি বছর বললাম আমরা সবাই দোকানদার চিন্তার কিছু নেই পাড়ার বিপ্লবী নেতা বাবুসোনাকে দেখলাম বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সেও সার্টিফাই করলো তুই সেই একইরকম আছিস ফস করে সিগেরেট জ্বালিয়ে বললোবাইপাস হয়েছে বললাম তাহলে সিগেরেট? উত্তর পেলাম, তাতে কি শালা, মালও টানি মেয়েটার বেলেঘাটায় বিয়ে দিলাম এখন আমি মুক্ত পুরুষ ক্ষমতায় নেই তো কিবিন্দাস আছি আমাদের নাটক দেখতে আসিস কিন্তু মনে মনে বললাম, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক

পাড়ার মোড়ে নতুন চপের দোকান হয়েছেনাম রসনা বাঃ বাঃ, একটা বাঙালী  নাম দেখে বেশ লাগলো এই দোকানের ছেলেটাকে চিনি না নতুন বোধ হয় হাব ভাব দেখে মনে হলো না আমাকেও চেনে  মন দিয়ে চপ ভাজছে কিসের চপ ভাই? জিজ্ঞেস করলাম, মোচার চপ আছে?  আমার ওপর নিচ মেপে উত্তর দিলো, ওসব আমরা রাখিনা। তবে এগুলো কি? ডিমের ডেভিল। আর কি আছে? চিকেন পাকোড়া, ফিশ ফ্রাই দাম কত? আরো একবার আপাদমস্তক মেপে নিলো চল্লিশতারপর কি ভেবে চোখের ইঙ্গিতে গলির ভিতর দেখিয়ে বললো, ভেতরে যান মোচা পাবেন বুঝলাম মোচার চপের খদ্দের হয়ে ফিশ ফ্রাইয়ের দাম জিজ্ঞেস করে গর্হিত অন্যায় করেছি এখন থেকে মোচার চপের জন্য গলির ভেতরে ঢুকতে হবে

গলির ভেতরে ঢুকেই মনা পাগলের সাথে দেখা মনা পাগলকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি সেরকমই টিংটিঙে রোগা, ঢলঢলে হাতাওয়ালা শার্ট ওপরের বোতামগুলো নেই মনা আবার মাকুন্দ ফর্সা মুখে গোঁফ দাড়ি নেই মাকুন্দ লোকেদের বয়েস বোঝা মুশকিল সেই একই রকম আছে বিশ্বায়নের কোনো প্রভাব মনার ওপর অন্তত নেই মনা সত্যিকারের পাগল কিনা সে বিষয়ে অনেকের সন্দেহ ছিল মনা পূব বাংলা থেকে আসা বাড়ির বড় ছেলে পূর্ব বাংলা থেকে খাল পারের  রিফুজি কলোনি সেখানেই মনার বাবা মিসিং মনার মা এক ডজন ছেলে মেয়ে নিয়ে কারো একটা দয়ায় আমাদের এই পাড়ায় উঠে এসেছিলো মনা তখন থেকেই পাগল অনেকে বলে আসলে পাগল নয়, সংসারের দায়িত্ব এড়াতে মনা পাগলের ভান করতো হতেও পারে ভান করতে করতে কত লোক সত্যি পাগল হয়ে যায় তাও হতে পারে সে সত্যি মিথ্যে যাই হোক, মনা চিরকালই খুব নিরীহ পাগল মনা পাগল চেইন স্মোকার দেখা হলেই বিড়ি চাইতো ছোট বড় সবার থেকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, মনাদা দিনে কটা বিড়ি খাও? আকাশের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিয়েছিলো চার বান্ডিল হবে। এই না হলে সেয়ানা পাগল দেখলাম সেই মনা পাগল সার্জেন জেনারেলের সতর্ক বার্তা ফুঁ মেরে উড়িয়ে দিয়ে দিব্যি আছে আগের মতোই পেছন থেকে ডাকলাম এই মনাদা...কেমন আছোমনা পাগলকে দেখে কোনোদিনই পাগল বলে মনে হয়না শুধু চোখের দিকে তাকালে কেমন যেন মনে হয় মনা পাগলের চোখগুলো কলকাতার আকাশের মতোই  ঘোলাটে কিছুতেই ফোকাস করা যায়না সেই আগের মতোই মনা পাগলের চোখের পলক পড়েনা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেমন আছো? উত্তর নেই...বুঝলাম মনা পাগল আমাকে ভুলে গেছে জিজ্ঞেস করলাম বিড়ি খাবে? তাও উত্তর নেই মনা পাগলের একটা গুণ আছে অচেনা লোকের থেকে বিড়ি খায় না


আজকে এখানে নিউ ইংল্যান্ডে উজ্জ্বল আকাশ সকাল থেকেই কেন জানিনা মনটা খুঁচ খুঁচ করছে মনা পাগলের ঘোলাটে চোখদুটো মনে পড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে, কলকাতার আকাশের মতো ....ডাল... নৈর্ব্যক্তিক... মনা পাগল কেন আমাকে চিনতে পারলো না?  এতো সুস্থ লোক সবাই আমাকে মনে রেখেছে, আর একটা পাগলকে নিয়ে কিসের এতো মাথাব্যথা দূর ছাই...এটাও একরকম পাগলামো


No comments:

Post a Comment